জাহিদুল আলম, ঢাকা
০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, 8:06 PM
কর্মির নামে বিদেশে নারী পাচার : নেতৃত্বের তীর বিএমইটি কর্মকর্তা গাফ্ফারের দিকে
* তৈরি হচ্ছে মানবিক সংকট
* চোখ বুঝে আছে উর্ধতন কর্মকর্তারা
*মন্ত্রনালয়ের হস্তক্ষেপ চান ভূক্তভোগীরা
বয়স গোপন, প্রশিক্ষণ ছাড়াই ছাড়পত্র প্রদান এবং ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিদেশে নারী কর্মি পাঠানোর আড়ালে শিশু থেকে বিভিন্ন বয়সী নারী পাচার করছে একটি চক্র। এমন অভিযোগের অনুসন্ধ্যানে বেরিয়ে এসেছে বিএমইটি ঘিরে গড়ে ওঠা রাজধানীর ৫০ রিক্রুটিং এজেন্সি দালার চক্রের এক সুবিস্তৃত নেটওয়ার্কের কাহিনী।
আর এই চক্রের পৃষ্ঠপোষক বা নেপথ্যের কালো মানুষ হিসেবে উঠে এসেছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এর উপ-পরিচালক মোঃ আব্দুল গাফফারের নাম। পাচার হওয়া এসব নারীদের বড় একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়াসহ অনেকে গর্ভবতী বা কেউ কেউ সদ্যোজাত সন্তান কোলে করে দেশে ফিরে আসার কাহিনীও রয়েছে।
জানা গেছে, পাসপোর্ট, বয়সের কাগজপত্র, প্রশিক্ষণ সার্টিফিকেট সবই ভুয়া তথ্যে তৈরী করে ৫০টিরও বেশি রিক্রুটিং এজেন্সির সাথে সংশ্লিষ্ট দালালরা প্রতিনিয়ত ফাইল জমা দিচ্ছে উপ-পরিচালক মোঃ আব্দুল গাফফারের মাধ্যমে। আর সে এসব ভ’য়া কাগজের কোন প্রকার যাচাই বাছাই ছাড়াই অুনমোদন দিয়ে কামিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। একটি বিশ্বস্ত সূত্রতমতে, উপ-পরিচালক মোঃ আব্দুল গাফফার ব্যক্তি গত জীবনে বহু সম্পদের মালিক বনে গেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কোন মহিলা কর্মী পূর্বে গৃহকর্মী বা (Domestic Worker) পেশায় বিদেশ গমন করে থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই বিএমইটি হতে বহিগমন ছাড়পত্র বা (বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স কপি) গ্রহণ করতে হয়েছে। আর যখনই কোন মহিলা কর্মী বহিগমন ছাড়পত্র বা (বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স) গ্রহণ করে থাকে, তখনই তার সকল ডাটা (ঙষফ ইগঊঞ ঝবৎাবৎ) এ রেজিস্ট্রেশন করা থাকে।
রেজিস্ট্রেশনে যে বিষয়গুলো উল্লেখ থাকে তা হলো : মহিলা কর্মীর ক্লিয়ারেন্স আইডি নম্বর, রেফারেন্স পাসপোট নম্বর (যে পাসপোর্ট নম্বর কর্মী বহিগমন ছাড়পত্র গ্রহণ করেছে), কর্মীর নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, জন্ম তারিখ, কর্মীর মোবাইল নম্বর ও তার ঠিকানা। যার পরবর্তীতে মহিলা ঐ কর্মীর প্রত্যাগত প্রমাণক হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু কোন মহিলা কর্মী বিএমইটি হতে বহিগমন ছাড়পত্র গ্রহণ না করলে তার কোন ডাটা (Old BMET Server) ) এ রেজিস্ট্রেশন করা থাকে না।
রিক্রুটি এজেন্ট যখন নতুন কোন মহিলা গৃহকর্মীদের বহিগমন ছাড়পত্রের জন্য বিএমইটিতে আবেদন করেন। তখন এ তারা সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক ফাইল প্রক্রিয়াগত নিয়ম না মেনে অনুমোদন দিয়ে থাকে।
সূত্র মতে,সিন্ডিকেটের কাজকে সহজ করে দিতে উপ-পরিচালক মোঃ আব্দুল গাফফারের নেতৃত্বে এজেন্সি মালিকদের দালালরা অসত্য প্রত্যাগত প্রমাণক যা সম্পূর্ণ ভুয়া একটি রেফারেন্স পাসপোট কপি তৈরি করেন। যে রেফারেন্স পাসপোটে পূর্বে বহিগমন ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছে এমন একজন মহিলা কর্মীর নাম, পিতা-মাতার নাম এবং জন্ম তারিখ উল্লেখ থাকে।
অর্থাৎ প্রকৃত আবেদনকারী মহিলা কর্মীর নামের সাথে মিল রয়েছে এমন একজন মহিলা কর্মীর রেফারেন্স নম্বর অনলাইনে দাখিল করে ((Old BMET Server) )নামক একটি ফোল্ডাবে, যেখানে প্রত্যাগত প্রমাণক এর সঠিক কাগজপত্রাটি যুক্ত করার কথা।
এমনকি (Old BMET Server )নামক ফোল্ডারে, ভুয়া একটি ক্লিয়ারেন্স কপি এবং রেফারেন্স পাসপোট কি যুক্ত করে থাকে এজেন্টরা, যেটা দেখে আবেদনকারী কর্মীর নিজস্ব প্রত্যাগত প্রমাণক এর ক্লিয়ারেন্স রেফারেন্স পাসপোট কপি মনে হবে। যদিও প্রকৃতপক্ষে তা সঠিক নয়,অর্থাৎ আবেদনকৃত কর্মীর প্রত্যাগত নয়। যখনই ঐ ক্লিয়ারেন্স কপি হতে ক্লিয়ারেন্স নম্বর দিয়ে(Returnee এ যাচাই করা হয়,
ঠিক তখনই দেখা যায় যে নতুন আবেদনকৃত কর্মীর সাথে -ক্লিয়ারেন্স কপিতে কর্মীর নামের মিল রয়েছে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বিদেশে নারী পাচারের কাজটিতে অর্থের বিনিময়ে করে যাচ্ছে গাপ্ফারের নেতৃত্বের নিস্ডিকেট। অথচ গাফ্ফারের দায়িত্ব ছিলো রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায গিয়ে তথ্য যাচাই করা।
যেখানে গেলেই ধরা পড়ে যায় যে, নতুন আবেদনকৃত কর্মীর জন্ম-তারিখ ও পিতা-মাতার নামের সাথে মিল নেই।তথইনি সম্পূর্ণ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে প্রত্যাগত প্রমাণক অন্য ব্যক্তির দাখিল করে বহিগমন ছাড়পত্র নেওয়ার অপচেষ্ট করা হয়েছে।
দৈনিক কালের ছবি এর অনুসন্ধানে উঠে আসা এমনি একটি চাঞ্চল্যকর তথ্যের উদাহরণ হলো-
MANPOWER CLEARANCE CARD G D‡jøL Av‡Q MST MEGHNA KHATUN, PASSPORT NO- A13358705, VISA NO-6133461224, FATHER NAME: ABDUS SAMAD, MOTHER NAME: MST SAMSUNNAHAR। কিন্তু পূর্ববর্তী রেফারেন্সকৃত পাসপোর্ট এ মহিলা কর্মীর নাম সঠিকভাবে দেওয়া হয়নি এমনকি তার বাবা ও মায়ের নামও ঠিকভাবে লেখা হয়নি ৷ অৰ্থাৎ টেম্পারিং করে বা এডিট করে বাবা মায়ের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
MST MEGHNA KHATUN Gi RvqMvq MST MEGHNA PERVIN উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যাগত মহিলা কর্মীর পূর্ববর্তী বিএমইটি রেজিষ্ট্রেশন ডকুমেন্ট এ মহিলা কর্মীর বাবার নাম MOKLES এবং মায়ের নাম MST RIMA BIBI এখানেও জাল-জালিয়াতি করে দেখানো হয়েছে অন্য পাতায়।
এই মহিলা কর্মীর ভিসা অন্য এজেন্সির নামে আসে কিন্তু উপ পরিচালক ভিসা সঠিক আছে কি না যাচাই-বাছাই না করে নথি পেশ করেন। যা প্রবাসী কল্যাণ আইনে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ ।
এরপরও বিএমইটি এর উপ পরিচালক আব্দুল গাফফার নথিটি যাচাই বাছাই না করে পরিচালক বরাবার উপস্থাপন করেন। অরজিনাল ডকুমেন্ট বলতে পূর্ববর্তী সঠিক ডকুমেন্ট এবং অনলাইনে দাখিকৃত ডকুমেন্ট হচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সি কর্তৃক দাখিলকৃত ভুয়া ডকুমেন্ট যা বিএমইটির বহির্গমন অফিসার যাচাই বাছাই করে সঠিক থাকলে বহির্গমন ছাড়পত্র প্রদান করে থাকেন ৷
এমনকি একজন ভুক্তভোগী নারী সাফিয়া বেগম। তিনি ১৭ মার্চ এইচ এ ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে সাফিয়া বেগম নামে এক নারী ছাড়পত্র পান, যার কোনো প্রশিক্ষণ নেই, নেই কোনো প্রত্যাগত পাসপোর্টও। একই দিনে প্রশিক্ষণ ছাড়া ছাড়পত্র পান মোসা. রতনা খাতুন নামের আরেক নারী, যার পাসপোর্ট নম্বর এ১৬০২৭৩২২ ও ভিসা নম্বর ৬১৩৮২০২১৮৩।
- অভিবাসন আইন ও বিষয় নিয়ে কাজ করছেন ব্যারিস্টার গিয়াস উদ্দিন। তিনি দৈনিক কালের ছবিকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে নারীর অভিবাসন রূপ নিচ্ছে এক করুণ মানবিক সংকটে। এই সংকটের পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতা, প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং চূড়ান্ত দায়হীনতা।
গড়ে উঠছে শোষণ ও পাচারের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। যারা এমন অপরাধের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। তিনি বলেন, অসত্য তথ্য উপস্থাপন বা তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে বহিগমন ছাড়পত্র গ্রহণের চেষ্টা “বৈদেশিক কর্মসংস্থান অভিবাসী আইন, ২০১৩’ এর ধারা ৩১ লঙ্ঘনের শামিল।
সূত্র বলছে, পাচার হয়ে যাওয়া নারীদের বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। অনেকে গর্ভবতী অবস্থায় ফিরছেন, কেউ কেউ সদ্যোজাত সন্তান নিয়েও ফিরেছেন। যা সমাজে একটি মানবিক সংকট তৈরী করছে।
বিএমইটি সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে উপপরিচালক আব্দুল গাফফার দৃশ্যে নেতৃত্ব দিলেও এই সিন্ডিকেটের সাথে বিএমইটির অনেকেই জড়িয়ে আছেন। অনুসন্ধ্যান করলে অনেকের মুখোশের আড়ালের মুখটি সামনে চলে আসবে। এ বিষয়ে জানতে কালের ছবির পক্ষ থকে উপ পরিচালক আব্দুল গাফ্ফারের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি কোন কথা না বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।