ঢাকা ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম
Marriage Notice দূর্নীতির বহুমাত্রিক অভিযোগ জাতীয় গৃহায়ণ প্রশাসকের বিরুদ্ধে ২০২৬ সালে যাত্রা শুরু করছে ‘ডা: ইদ্রিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’ পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ এক লটে ৭০৩ সরঞ্জাম: দরপত্রে ক্রয় আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ সাজানো মিথ্যে মামলায় জেল হাজতে খোকন সেখ: ফরিদ গঞ্জে ক্ষাভ টেকসই উন্নয়নে ফিলানথ্রপি উদ্যোগের ভূমিকা শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত রেলওয়েকে লাভজনক করতে উদ্যোগ চলতি বছরে জরিমানা আদায় ২২ কোটি টাকার বেশি তদন্তের মুখেও জৌলুশ বাড়ছে গণপূর্তের প্রকৌশলী স্বপন চাকমার দি ইবনেসিনা ফার্মাসিউটিক্যাল এর ৪১তমবার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত ২০২৫-২৬ কর বছরের আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় এক মাস বাড়ালো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড

দেশে সুশিক্ষা নিশ্চিতে আগামীর ভাবনা

#

০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫,  12:21 PM

news image

এস. এম. হায়াতুজ্জামান

শিক্ষাই মানুষের ভেতরকার সুপ্ত আত্মাকে জাগরিত করে। যার কারণেই শিক্ষাকে বলা হয় অমূল্য সম্পদ। যাকে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে ধরা হয়। শিক্ষা ছাড়া যেমন কোনো জাতি আগামীর পথে বা সামনে এগোতে পারে না।

শিক্ষাই এক মাত্র মানুষকে ভালো আর মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়। অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে। শিক্ষাই মানুষকে করে তোলে আত্মসচেতন। যার কারণে প্রতিটি জাতির জন্য শিক্ষাব্যবস্থা সর্বজনীন হওয়া উচিত। আর যদি তা সম্ভব করা না হয় তবে কোনো সমাজ বা জাতিই প্রকৃত আলোর সন্ধান পাবে না না। তাই প্রতিটি রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের আগে জাতীয় নেতাদের খুব সতর্ক ও কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হয়। তা না হলে জাতিকে একসময় এর চরম মূল্য দিতে হয়। আর কোনো রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট বলেই মনে করি।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। যেখানে শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, উচ্চশিক্ষার নতুন রূপান্তর, এবং শিক্ষার সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিথস্ক্রিয়া জোরদার এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি।

শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন ভাবনা
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন: শিক্ষাগত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীদের ও প্রশিক্ষকদের মধ্যে উন্নত মিথস্ক্রিয়া সম্ভব।

উচ্চশিক্ষার পুনর্গঠন: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধু শিক্ষার কেন্দ্র না রেখে রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবার এবং বিশ্লেষণ করার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

দীর্ঘস্থায়ী ও অব্যাহত শিক্ষা: প্রচলিত শিক্ষার বাইরে, পূর্ণকালীন নয় এমন শিক্ষার্থীদের জন্যও শিক্ষার সুযোগ উন্মুক্ত করা জরুরি, যা তাদের অব্যাহত শিক্ষা অর্জনে সহায়তা করবে।

দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষা: শিক্ষার্থীদের মধ্যে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং তাদের সমাজের চাহিদা পূরণে সক্ষম করে তোলার জন্য শিক্ষার বিষয়বস্তু ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক: আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেখানে তারা একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারবে।

গণঅভ্যুত্থানের শিক্ষা-কেন্দ্রিক দিক
গণতান্ত্রিক শিক্ষা: জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল একটি সামগ্রিক নেতৃত্বের ফসল, যেখানে কোনো একক নেতৃত্ব ছিল না। এই ধরনের গণ-আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে, শিক্ষাব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক চর্চা, মুক্তচিন্তা ও সহানুভূতির প্রসার জরুরি।

শিক্ষা ও সামাজিক পরিবর্তন: শিক্ষা কেবল পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তনের একটি হাতিয়ার। গণঅভ্যুত্থানের পর, এমন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম, সামাজিক দায়িত্ববোধ ও ন্যায়বিচারের চেতনা জাগ্রত করে।

পাশাপাশি সম্মানিত শিক্ষকরা সেই শিক্ষার কাণ্ডারি, ধারক ও বাহক এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের প্রকৃত কারিগর। মূলত শিক্ষক বলতে শুধু আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগুরুদেরই মূল্যায়ন করে থাকি। আসলে বিষয়টি এমন নয়। পৃথিবীর সূচনালগ্নে আমাদের আদিম পিতা-মাতার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। নবী-রাসুলরা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি। তবে তারা কি অশিক্ষিত কিংবা মুর্খ ছিলেন? মোটেই না। বাড়িতেও তাদের জন্য ছিল না কোনো গুরুগৃহ কিংবা হোম টিউটরের সাধারণ ব্যবস্থা। সবাই এক বাক্যে বলবেন তা কেমনে হয়? কারণ যুগে যুগে মহান আল্লাহর প্রেরিত এসব বার্তাবাহকই তো মানবকুলকে দিয়েছেন সঠিক আলোর দিশা।

একজন শিশুর প্রথম শিক্ষক তার পরিবার, তার বাবা-মা, যেখান থেকে সে পায় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা যা চরিত্র গঠনের মূল হাতিয়ার। তাই পারিবারিক শিক্ষার মধ্যে কোনো ঘাটতি না দুর্বলতা থাকলে একজন মানুষকে সারা জীবন ধরেই তার ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয়। মূলত এজন্যই নেপোলিয়ন সুন্দর একটি জাতি গঠনের জন্য শিক্ষিত মায়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ একজন স্বশিক্ষিত মা-ই পারেন একটি সুসন্তান উপহার দিতে।

এরপর শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এখানে সে অর্জন করে নিজেকে আলোকিত করার সব সরঞ্জাম। সমাজ ও রাষ্ট্র সেই শিক্ষাব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক একটি শিশুকে প্রথমে হাতে ধরে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে তোলে যদিও শিক্ষিত কোনো পরিবারে একজন স্বশিক্ষিত মা মহৎ এ কাজটুকু সম্পন্ন করার জন্য যথেষ্ট। আর এ কারণেই সুন্দর জাতি গঠনের জন্য শিক্ষিত একজন মায়ের প্রয়োজন এতটা বেশি। তাই প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা অপরিহার্য। এখানে ভালো বেতনে ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া না হলে বা কোটা ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলে শিশুরা সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে।

এভাবে ধাপে ধাপে একজন মানুষ হাইস্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পর্যায়ে অধ্যয়ন করে সম্পন্ন করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।

পাশাপাশি মানুষ বাস্তব শিক্ষা পায় প্রকৃতি থেকে, যা একজন মানুষকে বাস্তবতার কশাঘাতে টিকে থাকার কঠিন শিক্ষা দেয়। মানুষ পদে পদে দীক্ষা গ্রহণ করে বাস্তবতার বীভৎস রূপ থেকে। কর্মজীবনের প্রতিযোগিতার বাজারে প্রকৃতি প্রদত্ত বাস্তব শিক্ষা মানুষকে টিকে থাকতে সাহায্য করে যা কাউকে দুঃখের আগুনে পুড়িয়ে সোনা বানায়।

এভাবে মূলত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে যখন অন্য সব শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ সমন্বয় ঘটে, তখনই শিক্ষা পায় পরিপূর্ণতা। আর এ পথেই একজন শিশুর ভেতরে লুক্কায়িত সব সুপ্ত প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। গড়ে ওঠে দক্ষ মানবসম্পদ, জন্ম নেয় সুনাগরিক। পূর্ণাঙ্গতা পায় মানবজীবন। সমৃদ্ধ হয় দেশ ও জাতি। অতএব শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি ক্যাটাগরির উন্নয়নের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া অত্যাবশ্যক।

এরপর সবচেয়ে যেটি বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের কারিকুলামকে অনুসরণ করে বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা পদ্ধতিকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। যা আমি আগেই আলোচনা করেছি। এক্ষেত্রে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটিতে দলমত নির্বিশেষে অবশ্যই কোটার ভিত্তিতে না করে সত্যিকারের পণ্ডিতদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া উচিত।

ইতিহাস থেকে দেখা যায়- যে অনেক সময় নীরব ঘাতক ঘুণ পোকার মতো সবকিছু শেষ করে দেয়। তাই সর্ষের ভেতরকার ভূত শুরুতেই দূর করতে হবে।

পরিশেষে বলবো- বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং শেষমেশ চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একেকটা নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে আমাদের শিক্ষার্থীরাই। ঠিক যেই জেনারশন নিয়ে সুশীলসমাজের এত উদ্বিগ্নতা ছিল, সেই জেনারশনই এক প্রকার বাধ্য করল দেশের বৈষম্য দূর করতে, স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে। ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হলো, এ আন্দোলনে প্রাথমিকভাবে অংশ নিয়েছিলেন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এমনকি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা। পরবর্তী সময়ে সীমিত পরিসরে সরাসরি যুক্ত হয়েছেন শিক্ষক, অভিভাবক ও অন্যান্য সামাজিক শ্রেণী। চূড়ান্ত পর্যায়ে এ আন্দোলনে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন জ্ঞাপন করেছে।

এই আন্দোলনে কেবল স্থাপনা নয়; প্রচলিত ধারণা, অচলায়তন, চিন্তা-দর্শন, মূল্যবোধ, গতানুগতিক রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি বহুক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে; অযুত ইতিবাচক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করেছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা কতখানি কী কাজে লাগানো যাবে, তা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদেই জন্ম নিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, তাই তরুণ ছাত্রসমাজকে প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকাটাও বাঞ্ছনীয়। দেশের সকল শাখায় বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান দৃঢ় হওয়াটাও সময়ের দাবি।

মুক্তিযোদ্ধা ও বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের সব শহীদদের সত্যিকার অর্থে স্মরণ করতে হবে, এই প্রজন্মকে সকল শহীদদের যথাযথ মূল্যায়নেও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না, দেশকে নূতন করে গড়ে তোলার কাজে ঐক্য বদ্ধ প্রচেষ্টার হউক জয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে এমন সুযোগ হাত ছাড়া করা উচিত হবে না। বিগত সরকার শিক্ষাকে নিয়ে যেভাবে খেলেছে তার থেকে বেরিয়ে এসে প্রমাণ করতে হবে দেশে সুশিক্ষা নিশ্চিতে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ।

লেখক : এস. এম. হায়াতুজ্জামান, প্রধান শিক্ষক, লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, লোহাগড়া, নড়াইল।

সম্পর্কিত
logo

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ জাহিদুল ইসলাম