বিশেষ প্রতিবেদক
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, 7:08 PM
প্রতারণা ঢাকতে এবার কোম্পানি বদলের বিজ্ঞপ্তি বিআইএসএফ-এর
*ভুয়া নিয়োগে কোটি টাকার সিন্ডিকেট,
* জড়িত এমডি ও অ্যাডমিন ম্যানেজার
সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনসুলেটর সেনেটারি ফ্যাক্টরি বিআইএসএফ এ প্রকাশ্যে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। ভুয়া ঠিকানায় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নামে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ রেজাউল করিম ও অ্যাডমিন ম্যানেজার ফারুক হোসেনের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি এই ঘটনা চাপা দিতে ‘কোম্পানি বদলের’ নামে একটি কৌশলী বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে, যা ঘিরে ফ্যাক্টরির ভেতরে ও বাইরে তীব্র অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে।জানা যায়, ২০২৪ সালে আউটসোর্সিং কোম্পানী নিয়োগ দিতে বিআইএসএফ একটি দরপত্র আহ্বান করে।
নিয়ম অনুযায়ী একাধিক যোগ্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশগ্রহণ করে। তবে, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ম্যানেজার অ্যাডমিন ফারুক হোসেন ও এমডি রেজাউল করিম মিলে নিজেরাই “দেশী এন্টারপ্রাইজ” নামে একটি ভুয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়োগের দায়িত্ব তুলে নেন নিজেদের হাতেই।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, দেশী এন্টারপ্রাইজের ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, আয়কর সনদ, এমনকি অফিসের ঠিকানা সবই ভুয়া। এর ট্রেড লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় ৩০ জুন ২০২৪—তবুও নভেম্বর ২০২৪-এ এই কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এই ভুয়া কোম্পানির মাধ্যমে প্রায় ২০০ জনকে নিয়োগের নামে প্রতিজনের কাছ থেকে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা ঘুষ আদায় করা হয়। ফলে পুরো ঘটনায় ঘুষের অঙ্ক দাঁড়ায় ৫-৬ কোটি টাকা। এই টাকা সিন্ডিকেটের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
ঘুষ ও দুর্নীতির সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রেজাউল-ফারুক জুটি: বলা হচ্ছে, এই কেলেঙ্কারির মূল পরিকল্পনাকারী ম্যানেজার অ্যাডমিন ফারুক হোসেন, যিনি নিজের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ থেকে পরিচালনা করছেন দেশী এন্টারপ্রাইজের কার্যক্রম। যদিও কাগজে-কলমে কোম্পানির মালিকের নাম আলাদা, তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ট্রেড লাইসেন্সে থাকা মোবাইল নম্বরটি অন্য ব্যক্তির নামে এবং অফিসের ঠিকানা অস্তিত্বহীন।
অভিযোগ আরও রয়েছে, চাকরি প্রত্যাশীদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায়ের পর অনেককেই নিয়োগ দেয়া হয়নি, বরং ভুয়া সাক্ষাৎকার ও কাগজপত্র দেখিয়ে প্রতারণা চালানো হয়। কোম্পানি বদলের বিজ্ঞপ্তি: প্রতারণা ঢাকার নতুন ফন্দি! দুর্নীতির তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর বিআইএসএফ কর্তৃপক্ষ ‘কোম্পানি বদলের’ একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে, যাতে স্বাক্ষর করেন ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মোহাম্মদ আবু জাফর।
গণমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, “আমি এমডির নির্দেশেই কেবল স্বাক্ষর করেছি। আমি এখানে নতুন, অতীতের বিষয়ে আমার জানাশোনা নেই।” বিআইএসএফ -এর একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, “এখানে রেজাউল করিম ও ফারুক হোসেনের কথাই শেষ কথা। সরকারি বিধি-বিধান এখানে যেন প্রযোজ্য নয়।”
সূত্র জানায়, বিআইএসএফ -এর দুর্নীতি বিষয়ে বিসিআইসি ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হলেও তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।বরং, অভিযোগ রয়েছে, ঊর্ধ্বতন কতিপয় কর্মকর্তাও বিশেষ কোন সুবিধার বিনিময়ে এই সিন্ডিকেটকে রক্ষা করতে নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে!
বিসিআইসি এর বাণিজ্যিক পরিচালক মনির হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন,“আপনারা লিখিতভাবে চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন দিন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
আইন কী বলে: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা নিজ প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারী কোম্পানি খুলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন না। এটি সরাসরি সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা ও দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এই প্রতারণা ও দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত শুরু করা উচিত।” সরকারি চাকুরির নিরাপদ চেয়ারে বসে একজন কর্মকর্তা যদি নিজের ভুয়া কোম্পানি বানিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন, তাহলে রাষ্ট্রের ভেতরে যে দুর্নীতির ভয়াবহ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে তা স্পষ্ট বিআইএসএফ এর এই ঘটনা একটি নজিরবিহীন প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং আইনের লঙ্ঘনের জ্বলন্ত উদাহরণ।